Thursday, November 28, 2013

খুচরো কিছু শব্দ চেয়ে হাত পেতেছি নারীর কাছে/ দেবার মত ভূতল ছিল, সমুদ্র ও টিলাভূমি/আমি তো চাই প্রেমের মত আফোট কিছু শব্দগুচ্ছ/যা দিয়ে আজ ধরবো আমি ছায়াপথের নীহারিকা/বুকের মাঝে উল্কাপাতের নতুন খেলা, জিভের ডগায় মনিপদ্ম/ ওঁকারের ঐ গোপন কথা চন্দ্র এবং বীজের মত/ ওঠুক ফুটে এসব শব্দে, শিকড় ছড়াক নোনাজলেও ।/ খুচরো কিছু শব্দ দেবে, ঘোরের ভেতর নাচের ভেতর ?/ সঙ্ঘ এবং সঙ্গমের ঐ উঠে আসা ধ্বনির মতো শব্দ দেবে ?

Tuesday, November 26, 2013


হেঁটেছি গলিপথে,
তোমাকে খুঁজে খুঁজে
হয়েছি হয়রান ।

থেকেছি ঘাড় গুঁজে ।
1.
শক্তি চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে প্রথম দেখা শিলচরে । ৭৩ বা ৭৪ সাল । কাছাড় সাহিত্য সম্মেলনে তিনি অতিথি । আগের দিন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এসেছিলেন, চলে গেছেন পরদিন অর্থাত্‍ যেদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলেন । সার্কিট হাউসে এসে উঠলেন দুপুর বেলা । বন্ধু দেবাশিস তরফদার আর আমি দুজনে গেলাম দেখা করতে । মুড অফ তাঁর । তবু বললেন, আমার কবিতা পড়েছো ? কথাটা মাটিতে পড়েনি, দেবাশিস আর আমি কে বেশি শোনাতে পারি, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো । এই শক্তিদার ডাকে শিলচর থেকে পালাই কলকাতা বিনা টিকিটে । এবং তাঁর বণ্ডেল রোডের বাড়িতে গিয়ে ওঠি । সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি, মেঝেয় বসে ভাত খাচ্ছেন তিনি । দরজার দিকে পিঠ । শক্তিদা-- বলে, আমি আর কিছুই বলতে পারিনি, তিনি খ্যঁক খ্যঁক করে উঠলেন । নিচে, নিচে । নিচে গিয়ে বসো । মর্মাহত হয়ে, নিচে নামলাম । ছোটো এক কুঠুরি, প্রায়ান্ধকার । চুপচাপ বসে রইলাম । তিনমিনিটও যায়নি, তিনি নিচে এলেন নেমে । আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, তুমি ? কবে এলে ? তারপর আমার কথা শুনে বললেন, পালিয়ে এসেছো ? আমি জবাব দেবার আগেই তিনি উঠে গেলেন উপরে । দুমিনিট পরে নেমে এলেন । সঙ্গে মীনাক্ষীবউদি । হাতে চিনামাটির ডিশে করে গরম ভাত । পাশে বড় এক গলদা চিংড়ি । সেই প্রথম আমার গলদা চিংড়ি খাওয়া । আমার খাওয়া শেষ হয়নি, তার আগে একটা চিরকূটে কি যেন লিখলেন তিনি । তারপর বললেন, দশপনেরো দিন কলকাতা থাকবো না আমি । তোমার বউদিকে নিয়ে পাটনা যাচ্ছি । ততদিন স্বদেশ তোমার দায়িত্ব নেবে । এই নাও, চিঠিটা তাকে দেখালেই চলবে । আর এই কটি টাকা সঙ্গে রাখো । স্বদেশ ভারতী খুব ভালো লোক । হিন্দি ঔপন্যাসিক । আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি । একটা চারমিনার ধরিয়ে তিনি পুনরায় বললেন, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে ১৪ নম্বর বাস ধরবে । প্রতাপাদিত্য রোডে থাকে স্বদেশ । আমি এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছি । এসে কথা বলবো । তিনি কথা রেখেছিলেন । যদিও স্বদেশ ভারতীর ঘরে থাকা হয়নি আমার, কেন না তার ১০ বাই ১০ ঘরে সেদিনই বিহার থেকে তাঁর বৌ, ছেলে, শ্বশুর শ্বাশুরী শ্যালিকা এসে পড়েছিলেন । শক্তিদার চিরকূট পড়ে, তিনি আশ্চর্য এক সুরে বললেন, শক্তিদা পাঠিয়েছেন, আমার ঘাড়ে দুটি মাথা নেই, যে তা অমান্য করবো । দেখছেন তো আমার অবস্থা । নিজে কোথায় থাকবো, তাও বুঝতে পারছি না । শেষপর্যন্ত দুপুএরর পরেই তিনি আমার থাকার জায়গা ঠিক করলেন কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ঘরে । বললেন, শালা, তিনচারটে বেডরুম নিয়ে থাকেন একা । আপনি ওখানে আরাম করেই থাকবেন । সেদিন রবিবার । পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ঘরে চলছে তরুণ কবিদের আড্ডা । সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় থেকে তুষার চৌধুরী অনেকেই ছিলেন সে আড্ডায় । আড্ডা শেষে সবাই চলে গেলো । পবিত্র মুখোপাধ্যায় বললেন, চলুন, খেয়ে আসি । নিচে তাঁর সঙ্গে নামলাম । তিনি আমাকে মোড়ের একটা পাইস হোটেল দেখিয়ে বললেন, এই নিন আড়াই টাকা । এতে মাছভাত পাওয়া যাবে । আপনি খেতে খেতেই চট করে আমিও খেয়ে আসছি শ্বশুর বাড়ি থেকে । আপনাকে সঙ্গে নিলাম না । ছমাস ধরে কলেজে স্ট্রাইক । বৌকে পাঠিয়ে দিয়েছি শ্বশুরবাড়ি । নিজেও তাদের ঘাড়ে চেপে আছি । আমি খেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখি, তিনি দাঁড়িয়ে । হাসছেন । রয়্যাল লাঞ্চ কেমন হলো ? সন্ধ্যে অবধি গল্প হলো । গল্পের ফাঁকে 'ইউরেকা' বলে, চিত্‍কার করে উঠলেন তিনি । যোগ, যোগব্রত চক্রবর্তীর ওখানেই আরামসে থাকতে পারবেন আপনি । ব্যাটা একা থাকে মাকে নিয়ে । দি বেস্ট প্লেস । বলে, শক্তিদার ঐ চিরকূটের উলটে দিকে লিখলেন, হি ইজ ফ্রম আসাম । এণ্ড ইটস ইওর ডিউটি টু গিভ হিম শেলটার এজ ডিজায়ারড বাই আওয়ার গ্রেট পোয়েট শক্তি চট্টোপাধ্যায় । চিরকূটটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, শক্তিদা যোগর ঈশ্বর । আপনি নিশ্চিন্তে যান । হ্যাঁ, ঐ দশ পনেরোদিন আমি আশ্রয় পেয়েছিলাম কবি যোগব্রত চক্রবর্তীর বেহালার বাড়িতে ।

2.
যোগব্রত চক্রবর্তীর বেহালার বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধে হলো না । সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেক আগেই, গলিতে ঢুকে, দেখি, মোড়ে জটলা করে গুলতানি মারছে কয়েকজন ছেলে । তাদের যোগব্রতদার কথা বলতেই, ছেলেগুলি সমস্বরে বলে ওঠে, কবি যোগব্রত চক্রবতী ? আসুন, দেখিয়ে দিচ্ছি । হৈ হৈ করে, আমাকে নিয়ে এগিয়ে চললো তারা । পথে জেনে নিলো, কোথা থেকে এসেছি আমি, কি করি ইত্যাদি । একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে একসঙ্গে ছেলেগুলি বলে উঠলো, যোগদা, দেখো, আসাম থেকে এসেছেন ইনি । শক্তি চট্টোপাধ্যায় পাঠিয়েছেন তোমার কাছে । যাকে বলা হলো, তিনি, ঐ দোতলাবাড়ির রকে, চিত হয়ে শুয়ে আছেন, খালি গায়ে । এক ছেলে ফিসফিস করে আমাকে বললো, আজ মাত্রাটা বেশি হয়ে গেছে বোধহয় । কিছু মনে করবেন না, কবিরা এক আধটু খায় । তারা তো আমাদের মতো সাধারণ লোক না । তবে যোগদা ফাইন মানুষ । কোনো কিচাইনে নেই । এগিয়ে গিয়ে আমি হাতজোড় করে নমস্কার করলাম । তিনি, ঐ অবস্থাতেই, বললেন, ইয়ু আর ফ্রম আসাম ? শক্তিদা সেন্ট ইয়ু ? পরিস্কার শ্রীহট্টীয় উচ্চারণে বললাম, হ্যাঁ, শিলচর থেকে এসেছি, আমার নাম সমরজিত্‍ সিংহ । তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, দাঁড়াতে অসুবিধে হচ্ছিলো, একটা ছেলে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো । আপনি বাংলা জানেন ? আসুন, আসুন । আমার ঈশ্বর আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, এ আমার পরম সৌভাগ্য । আমি চিরকূটটি এগিয়ে দিলাম তার দিকে । উলটে পালটে দেখলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, পবিত্রও রয়েছে দেখছি । আসুন ভেতরে । ছেলেগুলিকে ধন্যবাদ জানিয়ে, যোগব্রত চক্রবর্তীর পেছনে পেছনে ভেতরে গেলাম । তিনি তখন শিশুর মতো । মা, দেখো, শক্তিদা কাকে পাঠিয়েছে ! আসামের কবি । আমাদের এখানে থাকবে । আজ ভালো কিছু রেঁধে খাওয়ায় । আমি তাকে তার ঘর দেখাচ্ছি । তিনি এবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেন আমাকে নিয়ে । একটা ঘরের দরজা খুলে লাইট জ্বালালেন, ঘর দেখিয়ে, বললেন, এ ঘরে থাকতে অসুবিধে হবে না তো ? আমি মাথা নাড়লাম । বিশাল এক হলঘর । আমার গাঁয়ের বাড়ি মনে পড়ে গেলো । দোচালা ছনের ছোট্ট এক ঘর । বৃষ্টি এলে জল ভেতরেই পড়ে, বিছানাকে বাঁচাতে মা আর আমার তখন কি তত্‍পরতা ! ঐ ঘরের তুলনায়, এ তো রাজপ্রাসাদের খাসমহল । আসলে এটা লাইব্রেরীঘর । একপাশে মেঝেয় জাজিম পাতা । সেটা দেখিয়ে বললেন, বিছানা করে দিচ্ছি, ততক্ষণে আপনি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন । তখনই আমার খেয়াল হলো, শিলচর থেকে পালিয়েছি আমি একবস্ত্রে । ভিখারির মতো ।
বারোদিনের মাথায় যোগদা জানালেন, কলকাতা ফিরে এসেছেন শক্তিদা । এ কয়দিন যোগদা আমাকে রেখেছিলেন আকবরের সন্তান সেলিমের মর্যাদায় । প্রথমরাতে, তিনি, খুব বিনীতভাবে, জানতে চাইলেন, 'মদ চলে ?' মাথা নাড়লাম, 'না ।' 'সিগেরেট ?' কোনো জবাব দিতে পারলাম না । কি জবাব দেবো ? বয়সে তিনি কত বড়, তার কবিতা শিলচরে বসেই পড়েছি অনেক । ষাটের দশকের তখনও যারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, যোগব্রতদা তাদের একজন । 'ও, বুঝেছি । আপনি বিশ্রাম করুন । মা রান্না সারতে সারতে গলায় আরও দু ঢোক ঢেলে আসি । বুঝতেই পারছেন, গলায় না ঢালা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই ।' তিনি চলে গেলেন । ঘরে বইয়ের রেক প্রচুর । ছোটোখাটো একটা লাইব্রেরী । একটা তাক থেকে বুদ্ধদেব বসুর 'তপস্বী ও তরঙ্গিনী' নিয়ে জাজিমে শুয়ে পড়লাম । এ বইটা তখনও পাঠ হয়নি আমার । পাতা খুলেছি, তখনই, তিনি এসে উপস্থিত । 'এই নিন ।' তাকিয়ে দেখি, চারমিনার । পাঁচ প্যাকেট । সঙ্গে একটা দেশলাই । 'শেষ হলে, বলবেন । এশট্রে নেই । ইচ্ছে করলে, পুরো ঘরটাকেই ইউজ করতে পারেন এশট্রে হিসেবে ।' এক ঘণ্টাও হয়নি, এক আত্মপরিচয়হীন তরুণকে কত আপন করে নিয়েছেন তিনি, ভেবে, অবাক হই । না কি, এ শুধুই শক্তিদার প্রতি অন্ধ টান থেকে ? তবুও ভেতরের মানুষটা যে, সত্যি, অন্যরকম, তা অনুভব করতে পারি । কলকাতা ফিরে এসেছেন শক্তিদা, এ খবর জানাতে গিয়ে, তার গলার স্বর কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলো । 'কাল শক্তিদা নিজে আসবেন এখানে । আপনাকে নিয়ে যেতে ।' অনিশ্চয়তার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম, ননভেলেবল ওয়ারেণ্ট এড়াতে । কলেজে পড়ি । ফার্স্ট ইয়ার । কমিউনিস্ট পার্টি করতে গিয়ে জেল খাটতে হলো । জেল থেকে বেরিয়ে, আর এক বিচ্ছিরি গণ্ডগোলে ফেঁসে গিয়ে, ডেকে আনি এই বিপদ । আমার নামে বেরিয়ে গেলো ওয়ারেণ্ট । তাও ননভেলেবল । কবি হিমাদ্রি দেব ও আমার সহপাঠী নূপুরের প্ররোচনায়, দশদিন আত্মগোপন করে থাকার পর, শিলচরে পালিয়ে যাই । আমার মা তখন হাত ভেঙে বিছানায় পড়ে আছেন । ঘরেও যেতে পারিনি মাকে দেখতে । এই অবস্থায় পালাতে হলো শিলচরে, যে শহর আমার অচেনা, যে শহরের কাউকে চিনি না আমি । এক অনিশ্চয়তা থেকে এসেছি আর এক অনিশ্চয়তায়, শুধু কবিতার জন্য । কাল আবার পাড়ি দেবো আর এক অনিশ্চয়তায় !

3.
ট্যাক্সিতে করে, যেখানে আমাকে নিয়ে এলেন শক্তিদা, সে জায়গাটাকে বলা হতো সাহেবপাড়া । অর্থাত্‍ ১৬ নম্বর থিয়েটার রোড । এখন সেখানে বিকে মার্কেট । আগে এখানে ছিলো অরূপ গুহঠাকুরতার রেকর্ডিংয়ের অফিস । রুমা গুহঠাকুরতাকে কে না চেনে ? ঐ বিশাল বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে ডাঃ কালীকৃষ্ণ গুহর চেম্বার । মূলত প্যাথোলজি হাউস । অনেকগুলি ঘর । তার একটাতে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন শক্তিদা । 'এই যে, কালীদা, ছোকরাটাকে নিয়ে এলাম । এবার একে মানুষ করার দায়িত্ব আপনার ।' বলে সামনের একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন শক্তিদা । দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি । সামনে বিশালদেহী এক বয়স্ক ভদ্রলোক । দেখতে অনেকটা হিন্দি সিনেমার জগগুর মতো । মিলিটারি ছাটের চুল, মুখে চুরুট । আমার দিকে তাকালেন তিনি । 'কবিতা লেখো ?' বাজখাই গলা কাকে বলে সেই প্রথম জানলাম । হঠাত মেঘগর্জন হলে যেভাবে চমকে ওঠে লোক, সেভাবেই চমকে উঠলাম আমি । বলা ভালো, আঁতকে উঠলাম । কোনোরকমে ঢোক গিলে, মাথা নাড়লাম । হ্যাঁ । 'শোনাও একটা ।' বুঝলাম, রীতিমতো আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তিনি । অর্থাত্‍ এই ইন্টারভিউতে পাশ করতেই হবে আমাকে । শক্তিদা এবার আমার মুখের দিকে তাকালেন । মনে করতে লাগলাম, সাম্প্রতিককালে কোন কবিতাটি আমার লোকে ভালো বলেছে । তখনই, মনে পড়ে গেলো রূপসীবাড়ির কথা । তোমাদের লালবাড়ির কথা । আমি শোনালাম তার একটা । তিনি চুপ করে রইলেন, দুমিনিট । তারপর বললেন, 'বাংলা সাহিত্যে অবজেকটিভ কবিতার ছড়াছড়ি । তুমি সাবজেকটিভ কবিতা লিখবে ।' তারপর, 'শক্তিদার দিকে ফিরে, বললেন, হাতটা বেশ । ছন্দটা, আরও তুখোড় হতে হবে । ও কে । ওর দায়িত্ব আমার ।' কিছুই বুঝতে পারছি না আমি । আমার কি দায়িত্ব নেবেন তিনি ? শক্তিদার উদ্দেশ্য আসলে কি ? কবিতা লিখতে এসেছি কলকাতা, যে কলকাতার মাত্র দুজনকে আগে থেকে চিনি । একজন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অপরজন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতী । আর তো কাউকে চিনি না । প্রথমদিন, শিয়ালদা স্টেশনে এসে যখন নামলাম, মানুষের ভীড় দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । উফ । এখানে যদি আমি হারিয়ে যাই, তাহলে আমার কি হবে ? ভয়ে ভয়ে, প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে এসে যখন দাঁড়ালাম, আমাদের কৈলাসহরের রথের মেলার ভীড়ের চাইতেও হাজার গুণ বেশি লোক এখানে । এত লোক কোথায় থাকে ? কোথা থেকে আসে ? রাস্তায় এসে অবাক হয়ে গেলাম, মাথায় বামুনের টিকির মতো টিকি লাগানো গাড়ি যাচ্ছে টিং টিং করতে করতে । সবাই দৌঁড়তে দৌঁড়তে উঠছে । অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখার পর মনে হলো, এ তো খুব সহজ, আমিও পারবো । উঠতে গেলাম, দরজার ঐ হাতলটা ধরতে গেলাম, পারলাম না, চলে গেল গাড়িটা । আর আমি পড়ে গেলাম হুমড়ি খেয়ে । হৈ হৈ করে ছুটে এলো লোকজন । লেগেছে ? কোথায় লাগলো ? দেখে চাপবেন তো ? ট্রামও ইদানিং প্রাইভেট বাসের মতো হয়ে গেছে । বাংলার উন্নতির তো এই হাল । কতকথা, কত লোক । একজন হাত বাড়িয়ে তুলে ধরলেন আমাকে । 'লাগেনি তো ? কোথা থেকে এসেছেন আপনি ? কলকাতায় এই প্রথম ?' পরিস্কার শ্রীহট্টীয় ভাষায় তার উত্তর দিলাম । এই উচ্চারণ শুনে সব লোক উধাও হয়ে গেলো মুহূর্তে । এইই কলকাতা, এখানেই থাকতে এসেছি, এই অচেনার ভীড়ে । ডাঃ কালীকৃষ্ণ আমার দায়িত্ব নেবেন এখন থেকে । তারপর ? তিনি আমাকে বললেন, 'এখানে তিনচারটে ঘর আছে । একটাতে তুমি থাকবে । আরও দুজন কর্মী আছে ।' তিনি থামলেন । তারপর পুনরায় বললেন, 'বিনে পয়সায় তোমাকে থাকতে দেবো না এখানে । আমার ছেলেকে, রোজ সকালে, কামারহাটি গিয়ে, পড়াতে হবে তোমাকে । সেখানেই লাঞ্চ করবে । দুপুর যেভাবে খুশি কাটাতে পারো, বিকেল চারটেয় আবার কামারহাটি যাবে । ছেলেকে পড়িয়ে, ছেলের মাকে নিয়ে, চলে আসবে এখানে । রাতের খাবার রুটি তরকারি এখানেই হবে । পারবে তো ?' কিছু বলতে যাবো, তার আগেই শক্তিদা বলে উঠলেন, 'পারবে না মানে ? আলবত্‍ পারবে ।'
4.
সারাদিন মনমরা । শক্তি চলে যাবার পর, ডাঃ কালীকৃষ্ণও বেরিয়ে গেলেন কোথায় যেন । যাবার আগে বললেন, 'তোমার রুটিন শুরু হবে কাল থেকে । আমার গাড়ি এসে প্রথম দিন নিয়ে যাবে তোমাকে । এরপর থেকে বাসে করেই যাবে আর আসবে ।' বলার মতো কিছু ছিলো না আমার । ছাত্র পড়ানোর শুরু সেই ছোটোবেলা থেকে । কলেজেকালে প্রচুর ছাত্র পড়াতে হতো গ্রাসাচ্ছদনের জন্য । জীবিকা হিসেবে বিরক্তিকর । এই প্যাথোলজি হাউসের ছেলগুলি, বয়সে আমার ছোটো, এসে কথা বললো অনেকক্ষণ । মেদিনীপুর থেকে এসেছে । বুঝলাম, এদের সঙ্গে বেশিক্ষণ আলাপ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব । অথচ থাকতে হবেই এদের সঙ্গে । একটা ঘরে নয়, এটাই বাঁচোয়া । ভালো লাগছিলো না কিছুই । মনে হলো, কলকাতা এসে ভুল করেছি । তার চেয়ে অনেক ভালো ছিলো শিলচর । মহিমালয় ছিলো, প্রান্তঃজ্যোতির রবিবারের পাতা সম্পাদনা করতাম মনের মতো করে, গতি পত্রিকার সাপ্তাহিক কলমের বিনিময়ে দুপুরে সম্পাদকের সঙ্গে লাঞ্চ করতাম ভালোমন্দ । ছিলো শতক্রতু ও মিথিলেশ, শেখর ও তপোধীর । দিদিভাইয়ের কথা তো স্পেশাল । নিজ হাতে কাঁটা বেছে মাছ খাওয়া আমাকে শিখিয়েছে দিদিভাই । কবিতা নিয়ে হৈচৈ, প্রেমতলার ট্রাফিক পয়েন্টে রাত বারোটায় তপোধীরের গলায় অমানুষ সিনেমার গান । কোনোটাই নেই এখানে । কবিতা কি লিখতে পারবো আর কোনোদিন ? কবিতার কথা মনে পড়তেই, দুচোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা । আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা এই কবিতা, তার কাছ থেকে দূরে যদি সরে যেতেই হয়, তাহলে বেঁচে থেকে কি লাভ ? সন্ধ্যের একটু আগে গেটের বাইরে এলাম রাস্তায় । উলটোদিকে নাগাল্যাণ্ড ভবন, তার বাঁদিকে ব্রিটিশ লাইব্রেরী । একটু এগিয়ে গিয়ে, রাস্তার এপার থেকে দেখতে লাগলাম লাইব্রেরী । আমাকে কি ঢুকতে দেবে সেখানে ? যেতে পারবো কোনোদিন ঐ লাইব্রেরীতে ? লাইব্রেরী আমার প্রিয়, আমার মনের খোরাক সেখানেই, বই পড়তে পারলে আমার আর কিছু দরকার পড়ে না । যোগব্রতদার ঘরে বই পড়েই সময় কাটিয়ে দিয়েছি সুন্দর । কলেজের লাইব্রেরী ছোটো ছিলো, ফলে সবকটি বই পাঠ করতে সময় লাগেনি বেশি । মনে মনে বললাম, একদিন ঠিক যাবো এই লাইব্রেরিতে । রাত একটু বাড়তেই সাহেবপাড়ার চেহারা পালটে যেতে লাগলো আমাকে অবাক করে দিয়ে । অরবিন্দভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে ফিরলাম ১৬ নম্বর থিয়েটার রোডে । ঘরে ঢুকতে যাবো, তিন চারটে গাড়ি এসে থামলো কালীদার চেম্বারের সামনে । সাত-আটজন লোক সেসব গাড়ি থেকে নামলেন, সঙ্গে, মনে হলো, তাদের বউরা । সবার পেছনে নামলেন যোগব্রতদা ও শক্তিদা । সবাই ড়ুকলেন কালীদার চেম্বারে । আমাকে দেখে, কাছে ডাকলেন শক্তিদা । তারপর, পাশের একজনকে, আমাকে দেখিয়ে, বললেন, 'সুনীল, এই হলো সমরজিত্‍ । কবিতা লিখবে, বলে, বাড়ি পালিয়ে এসেছে ।' আমি হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে, প্রণাম থাক, হাত জোড় করে নমস্কার করতে পর্যন্ত ভুলে গেছি তখন ।
5.
ক্রমে লোকজন আরও এলেন । ডাঃ কালীকৃষ্ণ চ্যাটার্জীর দেখা নেই তখনও । প্যাথোলজি হাউসের ছেলেগুলি তড়িত্‍ গতিতে জলের বোতল, গ্লাস, বরফ ইত্যাদি রেখে দিলো টেবিলে । কেউ একজন বের করলেন অনেকগুলি বোতল । ভাঙা হলো সেগুলি আবার প্রত্যেকের গ্লাসে গ্লাসে ঢালা হলো মুহূতে । আমাকে ডেকে নিয়ে একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে, শক্তিদা বললেন, 'নে, খা ।' আমি বিব্রত আর থরথর করে কাঁপছি । আমি যে সংস্কারের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছি, সেখানে বড়দের সামনে নেশাভাং করার রীতি নেই । তবুও রীতিভাঙায় আমার জুড়ি ছিলো না সেখানে । প্রথম যেদিন সিগারেট খেতে শিখি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, তখন সবে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি, এক প্যাকেট ক্যাপস্টেন কিনে ঘরে যাই । বাবার ঘরের সামনে গিয়ে, একটা সিগারেট ধরিয়ে বাবাকে ডাকি, 'বাবা...' তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলে বলে ওঠি, 'আজ থেকে সিগারেট ধরলাম । এখন আমি এডাল্ট । এই দেখো ।' বলে, ধোঁয়া ছাড়লাম সিগারেটের । তিনি, 'শুয়োরের বাচ্চা একটা' বলে, মুখের উপর দরজা দিলেন বন্ধ করে । হা হা হা করে হেসে উঠলাম আমি । বললাম, 'শুয়োরটা তো আপনি নিজেই । একটা খাঁটি রামশুয়োর ।' মা দৌঁড়ে এলেন আমাদের ঘর থেকে, আমাকে দেখে, আঁতকে উঠলেন, 'সিগারেট ধরেছো ? তা টাকা যোগাবে কে ?' আমার হাসি কি আর থামে ? কাকা ধারে কাছে কোথাও ছিলেন, এগিয়ে এসে, আমার মুখে সিগারেট দেখে বলে উঠলেন, 'আর আছে ? আমাকে একটা দে ।' রীতি ভাঙতে ভাঙতে এলেও, এখানে থর থর করে কাঁপছি । এঁরা আমার স্বপ্নের জগতের মানুষ । কতদিন, কত কত রাত 'আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ' আউড়ে গেছি একা একা । সেই প্রিয় কবি, শক্তিদা, ততক্ষণে জেনে গেছি, আয়ান রশীদ খান, বরুণ চক্রবর্তীরা আছেন এখানে, তাদের সামনে রীতি ভাঙার সাহস দেখাবার মুরোদ নেই আমার । যোগব্রতদা ত্রাণকর্তা, তিনি পাশ থেকে বলে উঠলেন, 'সমরজিত্‍ মদ খায় না, শক্তিদা ।' হো হো করে হেসে উঠলেন শক্তিদা, বললেন, 'ব্যাটা, মদ না খেলে কবিতা লিখবে কি করে ? অ্য: !'

6.
কামারহাটি, ভেবেছিলাম, ধারে কাছে কোথাও হবে, বেহালা বা টালিগঞ্জের মত, চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ । হা হতোস্মি ! এ যে ব্যারাকপুরের প্রায় কাছে । অন্তত প্রথমদিন তাই মনে হলো আমার । শ্যামবাজার থেকে টালাপার্ক হয়ে চিড়িয়া মোড়, সিঁথির মোড়, ডানলপ, রথতলা, গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে বি টি রোড ধরে । বি টি রোড বলতেই মনে পড়ে গেলো, ক্লাস ইলেভেনে থাকতেই সমরেশ বসুর উপন্যাস বি টি রোডের ধারে পড়ে ফেলেছি স্কুলের পড়া ফাঁকি দিয়ে । তখন গোগ্রাসে পড়ছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী । তাদের চোখ দিয়ে আবিষ্কার করছি আমার কলকাতাকে । নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান পড়ে রীতিমতো ভক্ত হয়ে গেলাম মতি নন্দীর । কলকাতার গলির এমন জীবন্ত বর্ণনা, মধ্যবিত্তদের টানাপোড়েন, পড়তে পড়তে, অনুভব করতে শুরু করি তখন থেকেই । বি টি রোডের ধারে আমাকে চমকে দিয়েছিলো এখানকার জীবনযাপনের চিত্র দেখে । সেই বি টি রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা । শেষপর্যন্ত পানিহাটির মোড়ে এসে গাড়ি বাঁক নিল বাঁদিকে । প্রায় এক দেড় কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে গাড়ি থামলো একটা বাড়ির সামনে । বাড়িটি কলকাতার মত নয় । শহরতলী তথন শহরতলীই । দালান ঘর । ডানদিকের একটা ঘরে আমাকে নিয়ে গেলেন ভেতরের এক ঘরে । আভিজাত্যের ছাপ আছে, অথচ কোথাও যেন মনে হলো, তা বড় ম্রিয়মান । এক ছোটোখাটো মিষ্টি চেহারর এক মহিলে এলেন ঐ ঘরে । পেছনে একটি ছয়সাত বছলের ছেলে । বুঝতে অসুবিধে হলো না, যে, এই ছেলেটিই আমার ছাত্র । একে দেখে, শিবরাম চক্রবর্তীর মন্টুর মাস্টারকে মনে পড়ে গেলো আমার ।

7.কামারহাটি থেকে থিয়েটার রোড ক্রমে হয়ে ওঠে পরিচিত । আমার ছাত্রটি বেশ তুখোড়, ফলে খাটনি ছিলো কম । অনেকদিন পড়া ফাঁকি দিয়ে আমরা চলে যেতাম গঙ্গার ঘাটের দিকে । ওকে শোনাতে হতো নানা গল্প । এত স্টক কি আমার আছে ? ফলে বানাতে হতো গল্প যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই । অনেক সময় বিরক্ত হতাম । কেন না, গল্পের দুটি বাক্য শেষ হবার আগেই ছাত্রটি বলে উঠতো, তারপর ? এই তারপর কথাটির তাড়া ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো আমাকে । শেষপর্যন্ত এক উপায় বের করলাম । তাও ছোটোবেলায় আমার কাকার গল্প বলার এক কৌশল । আমি ছেলেটিকে বলতাম এক ব্যাধ এর কাহিনী । ব্যাধ একবার এক জাল পেতে অসংখ্য পাখি ধরে ফেলে । অসহায় পাখিগুলি জালের ভেতর ছটফট করতে করতে হাল ছেড়ে দিলো হতাশ হয়ে । তখনই একটা পাখি লক্ষ্য করলো, জালে একটা ছিদ্র । পাখিটি ছিদ্র দিয়ে তার ঠোঁট ঢুকিয়ে দেখলো, বেরুতে পারছে কিনা । দু একবার চেষ্টা করতেই ফুড়ুত্‍ করে বেরিয়ে গেলো জাল থেকে । আমার ছাত্রটি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, তারপর ? হাসলাম । তার মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে বললাম, আর একটা পাখিও আগের পাখিটির অনুসরণ করে সেই ছিদ্রটি দিয়ে ফুড়ুত্‍ । তারপর ? এবার তৃতীয় পাখিটিও ফুড়ুত্‍ । তারপর ? ছাত্রের কণ্ঠে উত্‍কণ্ঠার ছাপ । ফুড়ুত্‍ । এভাবে ক্রমে কাহিনীর শব্দ সংখ্যা গেলো কমে । গল্প শুধু নয়, অংক পড়াতে গেলেও অনেক কথা বলতে হতো তার সঙ্গে । একদিন, একটা গুণ অংক নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেলো । তাকে বললাম, পৃথিবীতে যোগবিয়োগ ব্যতীত আর কোনো বিশুদ্ধ অংক নেই । এই যে গুণ দেখছো, আসলে এটা একটা যোগ মাত্র । ৩ x ৫ = ১৫ আসলে ৩ + ৩ + ৩ + ৩ + ৩ = ১৫ অর্থাত্‍ পাঁচটা তিনের সমাহার এটা । অংক এভাবেই শিখেছি ছোটবেলায় আমার শিক্ষক সুহাস মিশ্র স্যরের কাছে থেকে । অংক আমার কাছে একটা খেলামাত্র । সেই আমি অংক নিয়ে পড়তে পারিনি, বলে, আফশোস করি সবসময় । অংক যে খেলামাত্র, জেনে যাবার পর, অংকে তত্‍পর হয়ে ওঠে আমার ছাত্রটি । এতে আমার পরিশ্রম বেঁচে যায় অনেকখানি । গৃহশিক্ষকতা আমার কাছে নতুন নয়, ফলে, তেমন অসুবিধে হলো না এক্ষেত্রেও । সন্ধ্যেবেলা তাড়াতাড়ি পড়িয়ে চলে আসতাম থিয়েটার রোড । একদিন, কামারহাটি থেকে ফিরে এসে দেখি, বাইরে, একটা খাটিয়ায় চিত হয়ে শুয়ে আছে রাজপুত্রের মত এক যুবক । আমারই বয়সী । ভেতরে ঢুকতেই, যোগব্রতদা বললেন, আপনার দেশের ছেলে । দীপংকর । দীপংকর সাহা ।

8.
দীপংকর আগরতলার ছেলে । বাবা ইউবিআই এর এজেন্ট, এখন তাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বলা হয় । মিলিত কান্নাকাটি বলে ওর কবিতার একটি পুস্তিকা ইতিমধ্যে বেরিয়েছে । হাংরি কবি প্রদীপ চৌধুরীদের সংস্পর্শে এসে রীতিমতো হাংরি কবি সে । কলকাতায় শিল্পী অসিত পাল এর চলমান শিল্প আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত । চলমান শিল্প আন্দোলন তখন কলকাতার অন্যতম আলোচিত বিষয় । কলকাতার সকল দেয়াল ছবি আর কবিতায় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, খবরের কাগজও মাতামাতি করছে এনিয়ে । কবি সমরেন্দ্র দাস থেকে শুরু করে তরুণ শিল্পী পার্থপ্রতিম গঙ্গোপাধ্যায়, তপশ্রী সেন, সুতনুকা বাগচি, কে নেই এই আন্দোলনে ? ১৬ নম্বর থিয়েটার রোডের এই নৈশঠিকানায় কি করে সে এলো, সেই রহস্য প্রকাশিত নয় আজও । এসেছে একেবারে বেহুঁশ অবস্থায় । যখন হুঁশ ফিরলো, বললাম, 'আমি সমরজিত্‍, ত্রিপুরার ।' নেশাচ্ছন্ন চোখে তাকালো আমার দিকে. তারপর হাত বাড়িয়ে বললো, 'দীপংকর, হার্ডিঞ্জে থাকি । তোমার কথা শুনেছি ।' সে রাত থেকে দুজনে বন্ধু হয়ে যাই । তার হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে বহুবার গেছি, সেও এসেছে আমার কাছে । তার সঙ্গে অসিত পালদের চলমান শিল্পের শনিরবির আড্ডায় গেছি অনেকবার । পরের দিকে নিয়মিত যেতাম এস্প্ল্যানেডের গম্বুজের নিচের আড্ডায় । সে আর এক গল্প । থিয়েটার রোডের এই নৈশ আড্ডায়, একদিন, আমার কাঁধে চাপানো হলো ভয়ংকর এক দায়িত্ব । রোজ রাতে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে শক্তিদাকে । তার আগে, শক্তিদার চশমা এবং ঘড়ি খুলে পকেটে রেখে দিতাম । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলে দিলেন, 'শোনো, রোজ ঘড়ি ও চশমা হারাবার বিশ্বরেকর্ড তোমার শক্তিদা ব্যতীত আর ইহসংসারে কারও নেই । এটা ভুলে যেও না ।' পাশ থেকে শমিত ভঞ্জ, চলচিত্র নায়ক, ফোড়ন কাটলেন, 'আপনার বিশ্বরেকর্ডের কথাটিও বলে দিন ।' হো হো করে হেসে উঠলেন সবাই । ডাঃ কালীকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় বললেন, 'সন্দীপন এখনও রেকর্ড করতে পারেনি । পাঁচ ছ'বার নেশার ঘোরে জামাপ্যাণ্ট আণ্ডারওয়্যার সহ হারিয়ে ফেলেছে, বলে, একে রেকর্ড বলা যায় না ।' আবার হাসির ফোয়ারা । রাত তিনটে পর্যন্ত তরল আড্ডায় বুঁদ হয়ে থেকে, যে যার গাড়ি করে চলে গেলেন তারা । সন্দীপনদা ডাঃ চাট্যার্জির গাড়িতে । থেকে গেলেন শক্তিদা । তিনি আমার কাঁধে ভর দিয়ে, কোনো রকমে এলেন রাস্তায় । ট্যাক্সি ধরতে হবে বণ্ডেল রোড যাবার । রাতের ট্যাক্সি কখনই মনোমতো জায়গায় যেতে চায় না । নর্থ কলকাতা বললে, বলবে, বালিগঞ্জ যাচ্ছে । ঠকে ঠকে এটা শিখেছি । পথে নেমে ট্যাক্সি ডাকছি, ধরতে পারছি না । পেছন ফিরে তাকাতে দেখি, একটা ট্রাক থেকে নেমে আসছে পাঞ্জাবী ড্রাইভার আর একজন পাঞ্জাবী । 'আরে, সাহেবজী, ইয়ে আচ্ছা হুয়া । আজ হাম ইয়ে রাতকো রঙীন বানায়েঙ্গে ।' দেখলাম, শক্তিদা দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে, পুনরায়, চেম্বারের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন । দুই পাঞ্জাবীর বগলে দুই বোতল । মাঝরাস্তা থেকে এই অলৌকিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম, ভোর হতে বাকি নেই আর ।

Wednesday, November 20, 2013

গিলোটিন, তোমার প্রেমিক জানে বুঝি 
কীটদ্রষ্ট গোপন সন্ধির কথা ? রাত নেমে এলে
সে কি বলে আজও ঊনত্রিশ, ঊনত্রিশ ?

গিলোটিন, ধড়হীন সন্ধিপত্রটিকে 
নদীতে ভাসিয়ে দিও নিশিডাক এলে ।

Ratrimoth book Download

Friday, November 1, 2013

তোমাকে অনুভব করি, নীরবতা । এই শূন্যতার ভেতর জেগে ওঠা রন্ধনপ্রণালী, তোমাকে অনুভব করি, তীব্র অন্ত্রময় তুমি । যতিচিহ্নের আড়ালে বেড়ে ওঠা যৌনআবেদন, তোমাকেও অনুভব করি বাঁশীর ছিদ্রে । আজ, ৩১ অক্টোবর ২০১৩, অনুভব করি, ঐ ছিদ্রপথে, জেগে উঠছে উঁইঢিবি ।

- Samarjit Sinha

Il silenzio, mi sento. Sei acuta intenstinale, La Cucina sulla scia di questo vuoto, mi sento.Mi sento, La crescato punteggiatura di attrazione sessuale alla fenditura di fluta. Allora,Oggi,31 ottobre 2013, verme svegliato quello passago di foro, mi sento.
আমার অস্তিত্ব জুড়ে আছো তুমি, ওগো দীর্ঘশ্বাস...
মিহি ঠাণ্ডা পড়ে গেছে অন্তর জুড়িয়া । তাহাতে মরিল সখা অনলে পুড়িয়া ।।
একদিন এই পৃথিবীই থাকবে না । সূর্য থাকবে না । চন্দ্র থাকবে না । এই বায়ুমণ্ডল থাকবে না । এবং আমরাও পোদ্দারি করার জন্য থাকবো না কেউ । তখন ? ক্ষমতা, কাঁটাতার, লেখা, গান, ছবি, ভালোবাসা, ঘৃণা, লোভ, ঈর্ষা, মোহ, কাম, মাত্‍সর্য, গীর্জা, মঠ, মসজিদ বা মন্দির, পার্লামেন্ট, বেশ্যালয়, পানশালা, প্রতিষ্ঠান, অনাথ আশ্রম, থানা, জেলখানা কিছুই থাকবে না তখন । যদি সত্যিই এইই হয় সুদূর ভবিষ্যতে, তাহলে, এইসব তত্‍পরতার কোনো মানে আছে ? এই নিরীহ ও অমোঘ প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে, বিশু পাগলা তার চটের আচ্ছাদন খুলে ফেলে দিয়ে, ডান হাতের চেটো কপালে রেখে, যেন সে তার অদৃশ্য কমাণ্ডেণ্টকে স্যালুট করছে, বলে ওঠে, আসলে সব আত্মরতি । জাস্ট মাস্টারবেশন করে যাওয়া । নাথিং মোর ।
একদিন এই ফেসবুক ছিলো না, ইন্টারনেট ছিলো না, কমপিউটার ছিলো না, আরও কতকিছুই ছিলো না এই জগতে । না থাকার অনেক অসুবিধে ছিলো, আবার সুবিধেও ছিলো তখন । আজ, মনে হয়, এত কিছু সহজে পেতে পেতে, আমরা ভুলে গেছি ঐ সব কথা, আমাদের শৈশব, কৈশোর, তার আদিম সরলতা । ভুলে গেছি, সেইসব বিকেলগুলি যা হাডুডুর মাঠে ফেলে এসেছি কবে । নৌকো নিয়ে পালিয়ে যাওয়া হিমরাত, বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষের ত্রাণে ছুটে বেড়ানোর কথাও এখন আর মনে পড়ে না খুব একটা । এখন দেখি, পিঠে ব্যাগ নিয়ে শৈশব ও কৈশোর হারানো ছেলেমেয়েরা ছুটছে টিচারের বাড়ি । যেতে যেতে তাদের পথ মগ্ন থাকে মোবাইলে আর ফেসবুকে । তারা জানে না গ্রন্থাগারের পথ । পরীক্ষায় মার্কস তুলতে গিয়ে তারা যোগ দিতে পারেনি সৃষ্টির আনন্দে । বা তাদের অভিভাবকগণ বারণ করে রাখেন এসব থেকে । ফলে, ভাষার মহিমা উপলব্ধি করতে পারে না তারা । আধুনিক ইলেক্ট্রণিক জগত, ইন্টারনেট বা ফেসবুক যা কেড়ে নিয়েছে এবং যা দিয়েছে তার হিসেব কোনোদিন হয়তো নেবেন কেউ । কিন্তু ভাবী প্রজন্মকে দেখে আতংক ছাড়া আমার আর কিছুই হয় না ।
আমি মরে গেলে এই জগতের একটি ধুলিকণাও নড়বে না, একটি গাছের পাতাও পড়বে না ঝরে । যে যেমন ছিলো, যা যেমন ছিলো, তাই থেকে যাবে । সূর্য তার প্রথামত আপন কক্ষপথে থাকবে । গ্রহতারা সহ চন্দ্রালোকিত আকাশ তেমনই থাকবে । আর খুশি হবে অধিকাংশই, বলবে, বাঞ্চোত্‍ মরে গেছে ? যাক, বাঁচা গেলো । জ্বালিয়ে মারছিলো এতদিন ! তাদের ঐ খুশি দেখে, যদি আত্মা বলে সত্যিই থাকে কিছু, তাহলে, আমার ঐ আত্মা শান্তি পাবে খানিকটা । তবু, মরে গিয়ে, কাউকে তো খুশি করতে পারলাম । এই ইহজীবনে আমি কাউকে সুখি করতে পারিনি যে ! এতটাই অপদার্থ ও নিষ্কর্মা । বেজন্মাও বটে ।
মহাত্মা গান্ধী আর ইংরেজ শাসকের গোলটেবিল বৈঠক নয়, যা হলো খাওয়ার-টেবিল বৈঠক । প্রীতি আচার্য ও আমার মধ্যে । কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও হয়নি এই বৈঠকে । যা হয়েছে, তা আর কিছু নয়, কালীকৃষ্ণ গুহর পাঠবৃত্তে কালযাপন পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন । তা থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি, বিবেকানন্দ, ঈশ্বরবোধ, মৌলবাদ, কবিতা, ভালোবাসাহীনতা, যৌনবোধ, হতাশা, কলকাতা এবং ফেসবুক পর্যন্ত এই বৈঠকের পরিসীমা । তৃতীয়পক্ষ নেই বলে, সিদ্ধান্তহীন বৈঠক পাক-ভারত বৈঠকে পরিণত হলো শেষপর্যন্ত ।
মহাত্মা গান্ধী আর ইংরেজ শাসকের গোলটেবিল বৈঠক নয়, যা হলো খাওয়ার-টেবিল বৈঠক । প্রীতি আচার্য ও আমার মধ্যে । কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও হয়নি এই বৈঠকে । যা হয়েছে, তা আর কিছু নয়, কালীকৃষ্ণ গুহর পাঠবৃত্তে কালযাপন পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন । তা থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি, বিবেকানন্দ, ঈশ্বরবোধ, মৌলবাদ, কবিতা, ভালোবাসাহীনতা, যৌনবোধ, হতাশা, কলকাতা এবং ফেসবুক পর্যন্ত এই বৈঠকের পরিসীমা । তৃতীয়পক্ষ নেই বলে, সিদ্ধান্তহীন বৈঠক পাক-ভারত বৈঠকে পরিণত হলো শেষপর্যন্ত ।