Monday, September 23, 2013

মিথ্যা বলিব না । ধর্মাবতার, একটি উপন্যাস লিখিতে পারিলেই এই জগত হইতে বিদায় নিব, মনস্থ করিয়াছি । এই জগত আমাকে যত্‍সামান্য হইলেও পরিচিতি দিয়াছে, যাহা আমার প্রাপ্য ছিল না । অযোগ্যের প্রাপ্য বলিয়া কিছুই থাকে না । আমি জানিয়াছি, এই জগতের সকলই ধুলিবত্‍ । তবুও এই উপন্যাসটি লিখিতে চাহিতেছি, যাহাতে আমার মাতৃদেবীর আত্মা যত্‍সামান্য হইলেও শান্তি পায় । ইহজীবনে ভালোবাসা ব্যতীত কিছু চাহি নাই, ফলত তরুণী ভার্যার মাথা গুঁজিবার এক বাসস্থানও দিতে পারি নাই তাহাকে । বড় অভিমানিনী তিনি । এই জগত ত্যাগ করিয়া গেলে তাহার যে কি দুর্দশা হইবে, তাহা ভাবিয়া ভীত আমি । তথাপি যাইতে হইবে আমাকে । তাহার আগে ঐ উপন্যাসখানা রচনা করিতে চাহিতেছি । এই লোভ বা বাসনার জন্য যারপর নাই অপরাধী ও লজ্জিতও বটে । আমার এই কথা শুনিবার পর, যাহা রায় দিবেন, ধর্ম না মানিলেও, তাহা নতমস্তকে মানিয়া নিব ।
এই লেখাতে তোমার কথা রইল না ।
আগুন পোড়া ভালোবাসাও সইল না ।
এই লেখাতে আমার কথাও রইল না,
নুন সাগরে ডুবে যাওয়াও হইল না !
১. বিয়ের বাজারে হাজার ঝামেলা । ঘটকালি থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত যে দীর্ঘ রাস্তাটির কথা আমরা জানি, তার প্রতিটি বাঁকে ওত্‍ পেতে থাকে লম্বা নখওয়ালা বিপদ । কনেপক্ষের কাছে সে রূপবান আতংক । এরকম এক আতংকমহলে, একবার, সেই কলেজকালে, হঠাত্‍ গিয়ে উপস্থিত হয়ে পড়েছিলাম । আসলে, পিসিমার বাড়িতে বন্ধুদের সহ হাজির হয়েছিলাম সন্ধেবেলা । এই আমার এক দোষ, মন চাইলো তো, চল পানসি । ঘরে পা দিতেই, পিসিমার মেজোমেয়ে, রেণুকা, বলে ওঠলো, জানো, আজ যমুনার বিয়ে । যমুনা মানে রেণুকার জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে । ক্লাস নাইন, বলিউডের যে কোনো নায়িকা তার সৌন্দর্যের কাছে হার মেনে যাবে । কিশোরী যমুনার বিয়ে হচ্ছে ৪৫ বছরের এক লোকের সঙ্গে । চমকে ওঠি আমি । এ দেশে কত কিশোরী বা বালিকা কিছু বোঝার আগেই বসে পড়ে বিয়ের পিড়িতে । বাধ্য হয়ে । ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ক্রোধ জেগে উঠলেও নিজেকে শান্ত করি । ৭ কন্যাসন্তানের পিতার মুখ ভেসে ওঠে আমার সামনে ।
২. চমকের পালা ছিল আরও বাকি । বিয়ের আসরে গিয়ে, দেখি, পাত্রপক্ষ আমার অতিপরিচিত । দু একটা কথা তাদের সঙ্গে বলে, কনের বাড়িতে ঢুকে পড়ি । ভেতরে গুমোট পরিবেশ । চাপা সুরে কে যেন কাঁদছে । কাছে গিয়ে, দেখি, যমুনার মা, যিনি দূর সম্পর্কে আমার মাসি হন । যমুনার বাবা ফিসফিস স্বরে, মনে হলো, সে সুর চাপা ক্রোধ ও অপমান মিশ্রিত, বলে ওঠলেন, পই পই করে বলেছিলাম, মেয়েটার গতিবিধি ভালো নেই, সামলাও । কথা শোনোনি, এখন মুখে চুনকালি মেখে চলে গেল পালিয়ে । এখন কি করে মুখ দেখাবো ? এবার ডুকরে ওঠলেন মাসি । জিগ্যেস করে জানতে পারলাম, যমুনা পালিয়ে গেছে । 
৩. বিয়েবাড়ির বরমহলে তখনও হাসিঠাট্টার আসর । আর, ভেতরমহলে, তখন, প্রতিমা বিসর্জনের পর যে আবহ, তা । এই পরিস্থিতিতে, কিইবা করতে পারি আমি ? তারপর হঠাত্‍ মনে হলো, করতে হলে, আমাকেই কিছু করতে হবে । কোনো কথা না বলে, ঘর থেকে এলাম বেরিয়ে । বরপক্ষের একজন আমাকে ডাকলেন, বললেন, আচ্ছা, কনেকে কখন বিয়ের আসরে আনা হবে ? অম্লানবদনে মিথ্যে কথাটিই বললাম আমি । কনে হঠাত্‍ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আপনারা, দয়া করে, ধৈর্য ধরুন । আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি । না আসা পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরে থাকবেন ।
৪. যমুনার বাবাকে গিয়ে বললাম, don 't worry. আমি যমুনাকে খুঁজতে যাচ্ছি । একা মেয়ে কতদূর আর যাবে ? খুঁজে বের করবই । পাশে থেকে একজন বলে ওঠলো, সবগুলি ঘর এরং গাছগাছালি দেখে এসেছি । কোথাও যমুনা নেই । ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠি, গাছগাছালি কেন ? তিনি বললেন, ভাবলাম, যদি মেয়েটা গলায় দড়িটড়ি দিয়ে বসে ! এসব কথা শোনার সময় নেই আমার । যমুনার একটা বোনকে ডেকে বললাম, আচ্ছা, এই গ্রামে যমুনার কোনো ক্লাসমেট আছে ? একটু চিন্তা করে ও জানালো, আছে । বিন্দু । আর কথা না বাড়িয়ে পাড়ার দুতিনটে ছেলেকে সহ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী বা চতুর্দশী হবে । চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সারা গ্রাম । রাত বেশ হয়ে যাচ্ছে তখন । গ্রামে রাত ন'টা মানে গভীর রাত । বিন্দুর বাড়িতে গিয়ে তাকে ডেকে তুললাম । ও তখন শুয়ে পড়েছিলো । বিয়েতে নিমন্ত্রিত হলেও যমুনা বারণ করেছে তাকে যেতে ।
৫. বিন্দু থতমত খেয়ে গেলে সব শুনে । বললো, এসবের কিছুই জানি না আমি । ও শুধু বললো, যমুনা বলছিলো, জোর করে আমার গলায় দড়ি পরিয়ে দিচ্ছে বাবা-মা । বুঝলাম, যমুনার আপত্তি ছিল এই বিয়েতে । জানতে চাইলাম, যমুনার কোনো প্রেমিক ছিল ? হ্যাঁ । অমল । ঐ যে, জারইলতলী বাড়ি, ফুটবল খেলে । সেখান থেকে, সোজা অমলের বাড়ি । ১২/১৫ কিমি দূর । তার মানে আরও একঘণ্টার পথ । সব শুনে চমকে ওঠলো অমল । বাচ্চা ছেলে, গোঁফের রেখা দেখা যায় কি যায় না । ক্লাস টেন । যমুনা পালিয়েছে ? কেন ? আমি তাকে চেপে ধরলাম, তুমি জানো না ? সে সোজা পায়ে পড়ল লম্বা হয়ে । সত্যি বলছি, দাদা, মার কিড়া, আমি জানি না । ওকে তো বলেছিলাম, দেখো, আমি টেনে পড়ি, এখন বিয়ে করি কি করে ?

 ৬. অমলকে বললাম, এই প্রেক্ষিতে, তোমারও করণীয় আছে । চলো, আশেপাশের গ্রামগুলিতে খুঁজি । কারও না কারও বাড়িতে নিশ্চয় লুকিয়ে আছে যমুনা । হয় তার স্কুলমেট অথবা আত্মীয় । অমলের বাবা বললেন, হ্যাঁ, এই বিপদে তোমার পাশে থাকা উচিত । সেই রাতে আশেপাশের গ্রামগুলির প্রায় সকল বাড়ি ঘুরে ঘুরে খোঁজ করলাম আমরা । না, যমুনা কোথাও নেই । ভেতরে ভেতরে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ছি আমি । সুইসাইড করে বসেনি তো যমুনা ? যদি করে, কি হবে ঐ বাড়ির অবস্থা ? অথবা বরপক্ষ ? শহরে তাদের বাড়ি । কৈলাসহরের প্রাচীন পরিবার । সবাই তাদের শ্রদ্ধা করে একবাক্যে । কি করে তারা দেখাবে মুখ ? লোকে কি বলবে ? আমার মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন । শরীর আর মানছে না । ভগ্নমনোরথে ফিরতে শুরু করলাম সঙ্গীদের নিয়ে । অমলের মুখেও কথা নেই আর । রাত তখন প্রায় দুটো । যমুনাদের আগের গ্রামের একটা বাড়ির সামনে এসে বললাম, চলো, এই বাড়িতে গিয়ে একটু চা খাই । আমি আর পারছি না ।
 ৭. এই রাতে তাদের বিরক্ত করবো ? এটা কি উচিত হবে, দাদা ? হেসে ওঠলাম আমি । এই বাড়িটা আমার এক আত্মীয়ের । কিছু বলবে না । চলো । এই অসময়ে, তাদের ডেকে তুললাম আমি । আমার এক মামার বাড়ি এটা । আমাকে দেখে অবাক তারা । বললাম, একটা কাজে বেরিয়েছি । খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে । এখন দোকান পাবো কোথায় ? ফলে, তোমাদের জ্বালাতে এলাম । মনিপুরী গ্রাম, মনিপুরী বাড়ি এটা । রীতি অনুযায়ী বাইরের তিনদিক বন্ধ বারান্দায়, মনিপুরীরা বলে মাংকল, বসলাম আমরা । ঘরের ভেতরে দেখার উপায় নেই কিছু । আত্মীয় বলে ভেতরে ঢুকলাম আমি । ঘরের মাঝখানে, বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী, ব্রহ্মস্থান, সেখানে একটা চুল্লি । তাতেই কেটলী বসিয়ে যে চায়ের জল ফোটাচ্ছে, পেছন থেকেই, তাকে দেখে, মনে হলো, বড় চেনা । কাছে এগিয়ে গেলাম তার । এবং তাকে সামনে থেকে দেখেই অবাক হলাম আমি । তুমি ? এখানে ?
৮. মামী এগিয়ে এলেন । জানো, সন্ধ্যের পর এখানে এসেছে আজ । একা । কত করে বললাম । বোঝালাম । ওর এক কথা । না, সে যাবে না । চুপ করে কিছুক্ষণ রইলাম, তারপর বললাম, তোমার আবেগ, তোমার না মানার কারণ আমি বুঝি, যমুনা । ফীল করি তোমাকে । আবার তোমার বাবামায়ের কথাটিও ভাবো একবার । আরও পাঁচটি মেয়ে আছে তার । এই ঘটনার পর, তাদের অবস্থা কি হবে, একবার ভেবেছো ? যমুনা ফোঁস করে ওঠলো, আমার কথা তো কেউ ভাবলো না একবারও । ঐ বুড়োর সঙ্গে --- কথা শেষ করতে পারলো না সে । কেঁদে ওঠলো হাউমাউ করে । তাকে বললাম, বয়স, সন্দেহ নেই, অনেক বেশি । আমি তো চিনি তাকে । লোকটা ভীষণ ভালো । সুখে রাখবে তোমাকে । দেরি করো না, চলো । যমুনা কোনোমতেই যেতে রাজি নয় । উপায় না পেয়ে আমি অমলকে ডাকলাম ।
৯. অমলের সাইকেলের সামনে বসে যমুনা, পেছন পেছন আমরা ফিরে এলাম তাদের গ্রামে । অঘ্রাণের প্রথম সপ্তাহ । হালকা শীত পড়ে গেছে এসব এলাকায় । কুয়াশায় চাঁদ পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়, হূ হূ করে কাঁপতে কাঁপতে, তাদের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঢুকলাম আমরা । তড়িঘড়ি করে কনে সাজিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে যমুনাকে যখন তোলা হলো, তখন ভোর হতে আর দেরি নেই । এই বিয়ের পর রাজনৈতিক কারণে, বাড়ি ও রাজ্য ছেড়ে পালাই আমি । প্রায় আট বছর পর যখন তাদের দেখি. তিন সন্তানের মা হয়ে গেছে যমুনা । এবং আমার দেখা দশটি সুখী দম্পতির একটি তারা । যমুনা আমাকে বললো, তুমি জোর করে বিয়ে না দিলে এই সুখ আমি কখনই পেতাম না । যতবারই কৈলাসহর গেছি, যমুনা ও তার বর আমার খুব যত্ন করতো । চারবছর আগে, জানলাম, যমুনা ও তার বর, দুজনেই, মারা গেছে ক্যানসারে ।
এই, তুই আমাকে ভালোবাসিস ? ছেলেটা হঠাত্‍ জিগ্যেস করে বসে মেয়েটাকে । তার বুকে তখন উথালপাতাল ঢেউ । নৌকা ডুবে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে । ছেলেটার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে, বলে ওঠলো, তুই আমাকে তিতির পাখির ডানা এনে দিবি ? হাঁ করে তাকিয়ে রইল ছেলেটা । তিতির পাখির ডানা ? পাখি নয়, পাখির ডানা ? এ কি ধরণের বায়না ? মাথায় কিছু ডুকছে না ছেলেটার । মেয়েটাকে তার ভালো লাগে । সামনে এলেই তার উথালপাথাল ঢেউ, আর ঐ ঢেউয়ে নৌকা প্রায় ডুবু ডুবু । কলেজ থেকে ফেরার পথে কিছুটা সময় এই পার্কে বসে থাকে তারা । কথা বলে না । চুপচাপ । তারপর চলে যায় যে যার ঘরের দিকে । আজ আর থাকতে পারেনি, সরাসরি জিগ্যেস করে বসলো, আমাকে ভালোবাসিস তুই ? আর মেয়েটা চাইছে তিতির পাখির ডানা ? সন্ধ্যে নেমে এল পার্কে । মেয়েটা নীরবে উঠে দাঁড়ালো । বললো, আসি । এক স্তব্ধতার ভেতর থেকে ছেলেটি দেখলো, মেয়েটা তিতির পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার আকাশে ।
সুখ আসলে কি ? এই নিরীহ প্রশ্নটির সামনে অসহায় ছিলেন উপনিষদকারগণ । ব্যাসদের যুধিষ্ঠিরের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, অঋণী থেকে সন্ধ্যায় যিনি শাকান্ন ভোজন করেন, তিনিই সুখী । সুখের সংজ্ঞা দেননি তিনিও, এড়িয়ে গেছেন । গ্রামবাংলার লোকজন তবু সহজ সরল করে বলতে চেয়েছেন, ঘামাচি হলে চুলকাতে পারাটাই সুখ । গোপাল ভাঁড় এর গল্প অল্পবিস্তর জানি আমরা । এসকল পার হয়েও সুখ এর সংজ্ঞা থেকে গেছেই অধরা । দুঃখের বিপরীত হিসেবে ।
ইলিশ ভাজা চলছে সরোবরে । ভাজা হয়ে গেলেই ডুব দেবো আজ । নির্ঘাত্‍ । তখন বাকার্ডি এসে কাকুতিমিনতি করলেও মানবো না । আজ আমার ডুব দেবার দিন । শাস্ত্রমতে । ইলিশ ভাজাটাই যা বাকি !
সে-ই আমাকে জাগায়, যে থাকে অন্তরে । তার ভালোবাসার স্পর্শে ঘুম ভাঙে আমার, আবার রাতে ঘুমিয়েও পড়ি । রূপোর কাঠি আর সোনার কাঠি তারই হাতে ।