আমার মাতৃভাষা
নেই, ধাত্রীভাষা আছে । ভুল বললাম । মাতৃভাষা, বলে, যাকে জানি, সে দুয়োরাণী ।
তার কথা জানে না অনেকেই, যারা জানে, তারাও কপাল
কুঁচকে বলে ওঠে, ও এটা তো বাংলার উপভাষা ! কেউ, হয় তো, বলে ওঠে, অহমিয়া ভাষার মত
লাগছে না ? এসব কথা শুনি, আর মরমে মরে যাই । ফোঁস করে উঠতে গিয়ে, চুপ করে থাকি, ভাবি, নীরবতার মত বড়
ভাষা নেই আর । এই যে উন্নাসিকতা, আসলে তা বড় ভাষাগুলির আগ্রাসনের এক রূপ ।
এই আগ্রাসনের মুখে ছোট ছোট ভাষাগুলি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে জেরবার । এই বিপদ
থেকে বাংলা বা অহমিয়াও মুক্ত নয় । বাংলার তবু স্বাধীন এক রাষ্ট্র আছে, সে বাংলাদেশ ।
উড়িয়া বা অহমিয়ার তা নেই । ফলে, রাষ্ট্রভাষা হিন্দীর আগ্রাসনের থাবা তাদের
ঘাড়েও । আবার ইংরেজির আগ্রাসী থাবার হাতে অসহায় এই হিন্দীও । এই সংকট যদি উপলব্ধি
না করি, তাহলে বুঝতে পারব না, কি কৌশলে, উত্তরপূর্বাঞ্চলের
রাজ্যগুলিতে, পোস্টকার্ডে বা ব্যাংকের কাগজপত্রে, অহমিয়া ভাষায়
জন্মনিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞাপন বা নির্দেশাবলী রাখা হয়, তা, আসলে, ঐ আগ্রাসনেরই রূপ
। এই রাজ্যে ককবরকের আগ্রাসনে হারিয়ে গেছে কলইদের মুখের ভাষা । তারা এখন ককবরক
ভাষায় কথা বলেন । এই চিত্র সর্বময় । আমার মা যে ভাষায় কথা বলতেন, সেই বিষ্ণুপ্রিয়া
মনিপুরী, ১৫২৭ সাল থেকে প্রবল চাপের মুখে । লোকমুখে টিকে রয়েছে এতদিন, তা ঐ প্রাণের
টানে, যে প্রাণের টানে জব্বার বরকতরা দিয়েছিল প্রাণ ১৯৫২ এর ২১
ফেব্রুয়ারি । প্রাণ দিয়েছিল, ১৯৬১ সালে ১৯ মে, কমলা ভট্টাচার্যরা
বা এই কয়েক বছর আগে, বরাক উপত্যকার পাথারকান্দিতে, বিষ্ণুপ্রিয়া
মনিপুরী ভাষার দাবিতে, প্রাণ দিয়েছিল সুদেষ্ণা সিংহ নামে ঐ
কিশোরী । আজ একুশে, এই যে উত্সব মাতৃভাষার নামে, বিস্ময়ে লক্ষ্য
করি, তা, মূলত, প্রাণের উচ্ছ্বাস
। মাতৃকথা মনে পড়লে, সৌভাগ্যবান ভাবি নিজেকে । জন্মসূত্রে, আমার দুই মা, দুই মাতৃভাষা ।
আমার মাতৃভাষা নেই, আমার মাতৃভাষা আছে । এই সত্য কি করে
অস্বীকার করি আজ ?
No comments:
Post a Comment